Powered by Blogger.

প্রেমিক থেকে জল্লাদ

জল্লাদ শাহজাহান ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ানো মানুষটিকে কিছুক্ষণ পরই চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে। নিজের চোখের সামনেই শুধু নয়, জলজ্যান্ত ওই মানুষটিকে ...

জল্লাদ শাহজাহান

ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ানো মানুষটিকে কিছুক্ষণ পরই চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে। নিজের চোখের সামনেই শুধু নয়, জলজ্যান্ত ওই মানুষটিকে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করতে হবে নিজ হাতে। কনডেম সেল থেকে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া, গড়িমসিতে জোর করা, এরপর ফাঁসির মঞ্চে দাঁড় করিয়ে যম টুপি পরিয়ে দেওয়া, গলায় দড়ি পেঁচিয়ে মঞ্চের লিভার (লোহার তৈরি বিশেষ হাতল) টেনে ধরা। যেন ফাঁসির দড়িতে গলায় পেঁচানো ব্যক্তিটির পায়ের তলা থেকে কাঠ সরে যায়। কাঠ সরতেই ঝুলতে থাকবে কয়েক সেকেন্ড আগেও যিনি ছিলেন জীবন্ত একজন মানুষ।

সাধারণের জন্য পুরো বিষয়টি অতি ভয়ঙ্কর হলেও নরসিংদীর শাহজাহানের জন্য এটি এখন ডাল-ভাত। নরসিংদীর শাহজাহান হলেন, জল্লাদ শাহজাহান। তিনিই এখন বাংলাদেশের কারাগারের প্রধান জল্লাদ। ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া কোনো আসামিকে দড়িতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করাই এখন যার পেশা। দায়িত্ব পালনের মতোই কারাগারের ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে যাচ্ছেন সেই ১৯৮৯ সাল থেকে। ফাঁসিতে ঝোলানোর রেকর্ড করেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনিসহ দেশের আলোচিত প্রায় সব ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন প্রধান জল্লাদ শাহজাহান।

এই শাহজাহানই এখন বিশ্বের দীর্ঘসময়ের (৩৪ বছর) কারাবন্দী। ৩৩ জনের ফাঁসি দিয়ে তিনি রেকর্ড করেছেন জল্লাদ হিসেবে। তিনি একমাত্র জল্লাদ যিনি একরাতে দুই কারাগারে চারজন আসামিকে ফাঁসি দিয়েছেন। তাকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অভিনয় জগতের জল্লাদদের 'আইডল'-ও বলা হয়ে থাকে। সর্বশেষ তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কাদের মোল্লাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রায় কার্যকর করেন।

কে এই শাহজাহান

নরসিংদীর পলাশ উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের এই শাহজাহানের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৬ মার্চ। অবিবাহিত এই শাহজাহান এইচএসসি পাস করেছেন নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে। তিনি কিছুদিন সেনাবাহিনীতেও চাকরি করেন। কিন্তু প্রেম করে গ্রামছাড়া শাহজাহান অপরাধ জগতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৭৩ সালে এইচএসসি পরীক্ষা শেষে যোগ দেন কমিউনিস্ট পার্টিতে। তার পারফরমেন্স দেখে কেন্দ্র থেকে তাকে ডেকে পাঠানো হয়। ১৯৭৬ সালে তাকে নরসিংদী জেলার কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এইচএসসি পাস করা এই শাহজাহান খুন, ডাকাতিসহ অপরাধের সব শাখায় বিচরণ করেছেন। মাত্র তিন বছরের মধ্যে তিনি ৩২টি খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন।

এরপর তাকে থামতে হয়েছে ১৯৭৯ সালে। মাদারীপুর জেলায় ছিল তার জীবনের সর্বশেষ অপারেশন। সেখানে অপারেশন শেষ করে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করেন।

গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে, শাহজাহানের দল মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় যাচ্ছে। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জেনে জান। সব জেনেই ওই এলাকা দিয়ে ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

রাতভর মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে বন্দুক যুদ্ধ করেন কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশে রওনা হন, তখন পুলিশের সঙ্গে আবারও সংঘর্ষ হয়। এ সময় গ্রেফতার হন শাহজাহান। তাকে সেখানেই থামতে হয়। এরপর থেকেই তার বন্দী জীবন।

৩৬ মামলায় ১৪৩ বছরের জেল

১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে তার নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি এবং অবশিষ্ট ৩৪টি হত্যা মামলা। বিচারকাজে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছরের। পরে ১০০ বছর ক্ষমা করে তাকে ৪৩ বছরের জেল দেওয়া হয়। শাহজাহানের জেল থেকে বের হওয়ার তারিখ তার জেল কার্ডের ওপর লেখা রয়েছে, 'ডেট অব রিলিজ ২০৩৫'। তখন তার বয়স হবে ৮৫।

তার হাতে

উল্লেখযোগ্য ফাঁসি

৩৩টি ফাঁসি দিয়েছেন শাহজাহান। যা দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ফাঁসি দেওয়ার রেকর্ড। তার দেওয়া উল্লেখযোগ্য ফাঁসিগুলো হচ্ছে- ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে শহীদ সাংবাদিক কন্যা শারমীন রীমা হত্যা মামলার আসামি মুনিরকে, ১৯৯৭ সালে বহুল আলোচিত ডেইজী হত্যা মামলার আসামি হাসানকে, ২০০৪ সালের ১০ মে খুলনা জেলা কারাগারে এরশাদ শিকদারকে, ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর রংপুর জেলা কারাগারে ইয়াসমীন হত্যা মামলার আসামি এএসআই মইনুল হক ও আবদুস সাত্তারকে, ২০০৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরে ইয়াসমীন হত্যা মামলার আরেক আসামি পিকআপ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণকে, ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ কাশিমপুর ও ময়মনসিংহে জঙ্গি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার মামুনকে, ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যু দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ খুনি বজলুল হুদা, আর্টিলারি মুহিউদ্দিন, সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদকে। সর্বশেষ জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেন আলোচিত এই জল্লাদ।

জেলজীবন

শাহজাহানের ঘনিষ্ঠ ও অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, জেলখানায় তিনি জল্লাদ শাহজাহান নামেই পরিচিত।

এমনকি তার জগ-বালতি-প্লেটের ওপরও লেখা রয়েছে জল্লাদ। অন্যদের মতো জল্লাদ শাহজাহান নতুন হাজতিদের থাকা, খাওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা করে থাকেন। বিনিময়ে কিছু টাকা পান এবং তা দিয়ে এখানে তিনি একটু আরাম-আয়েশে থাকেন।

তার দায়িত্বে প্রায় ২২ জন লোক রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজনকে তিনি ফ্রি খাওয়ান এবং বাকিরা নতুন হাজতি, আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকে বলে তারা টাকা দিয়ে থাকে। এই টাকা সিট বিক্রেতা, সুবেদার, জমাদার, জেলার থেকে শুরু করে জেলসুপার পর্যন্ত ভাগ পান।

তাদের ভাগ দেওয়ার পর যা বাঁচে তা দিয়ে শাহজাহানের দিন ভালোই কেটে যায়। সপ্তাহে একদিন পোলাও মাংশ খাওয়ার ব্যবস্থা করেন তিনি। বর্তমানে তিনি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মেঘনা-২ ভবনে সিআইডির দায়িত্বে রয়েছেন।

শাহজাহান ভূঁইয়ার ভাগ্নে ইছাখালী গ্রামের নজরুল ভূঁইয়া জানান, 'আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন মামাকে পুলিশ গ্রেফতার করে।'

তার মামা বাম রাজনীতি করত বলে তার নানা তাকে খারাপ চোখে দেখতেন। এর মধ্যে কারাগারে একবার মামার সঙ্গে দেখা করতে যাই। মামা জানান, সাজা মওকুফের জন্য জল্লাদ হয়েছেন। তিনি এখন মুক্তি চান।

মুক্তি পেলে কোনো অন্যায় করবেন না। বাকি সময় ভালো কাজ করে

জীবন কাটাবেন।

 

প্রেমের জন্য ঘরছাড়া

পাশের বাড়ির একটি মেয়েকে ভালোবাসতে গিয়ে যাকে গ্রাম ছেড়ে পালাতে হয়েছিল, সেই শাহজাহানের এখন আর কোনো আবেগ নেই। জল্লাদের কাজ করতে গিয়ে আবেগ-ভালোবাসাকে ত্যাগ করেছেন। কারাগারে কোনো ফাঁসি দিতে গেলেই ডাক পড়ে শাহজাহানের। দীর্ঘ সময় কারাগারে একসঙ্গেই ছিলেন এমন মুক্তি পাওয়া বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু তার সাজা কমানোর জন্য তিনি ফাঁসির কাজটি করে যাচ্ছেন। কিন্তু পাথর মনের অধিকারী হলেও শাহজাহানেরও এখন মন কাঁদে। তিনিও চান মুক্ত পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে। জীবনের অধিকাংশ সময় জেলে কাটানো শাহজাহান শেষ বয়সে এসে জল্লাদ জীবন থেকে সরতে চান। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে তিনি বেশ কয়েকবার আবেদন-নিবেদনও করেছেন। চেয়েছেন কারা জীবনের মুক্তি।

 

যেভাবে জল্লাদ শাহজাহান

জীবনের সোনালি সময়গুলো যেহেতু তার কারাগারেই কাটাতে হবে, সে কারণে তিনি জল্লাদ হিসেবে নাম লিখান। এতে তার সাজার মেয়াদও কমবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহ দেখান। প্রথম ১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনের প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেওয়া। তার যোগ্যতা দেখে আট বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের আসন প্রদান করে। প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজী হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন। কারা সূত্র জানায়, একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয়জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের দুই মাস চার দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ করা হয়। এ ছাড়া কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।

 

COMMENTS

Name

Gmail,1,আত্বহত্যা,1,আবিষ্কার,1,ইমেইল,1,ইসলাম,5,এক্সক্লুসিভ,117,এফিডেভিট,1,ঔষধ,1,কবিতা,2,কসম্যাটিক,1,কসম্যাটিক সার্জারি,1,কাজী,1,কাবিন,1,কোর্ট ম্যারেজ,1,গল্প,1,দিটেকজার্নাল,1,প্রচ্ছদ,2,প্রযুক্তি,2,প্রেম,1,বিজ্ঞান-প্রযুক্তি,5,বিনোদন,6,বিবিসি,1,ব্লক সাইট,1,ভিক্ষাবৃত্তি,1,ভিডিও,3,ভ্রমণ,7,মুক্তমত,1,মুক্তিযোদ্ধা,1,রেসিপি,2,লাইফস্টাইল,5,সম্পর্ক,7,সার্জারি,1,সাহিত্য,3,হামদর্দ,1,
ltr
item
blog: প্রেমিক থেকে জল্লাদ
প্রেমিক থেকে জল্লাদ
blog
http://bdview24me.blogspot.com/2013/12/blog-post_85.html
http://bdview24me.blogspot.com/
http://bdview24me.blogspot.com/
http://bdview24me.blogspot.com/2013/12/blog-post_85.html
true
4108433919245401245
UTF-8
Loaded All Posts Not found any posts VIEW ALL Readmore Reply Cancel reply Delete By Home PAGES POSTS View All RECOMMENDED FOR YOU LABEL ARCHIVE SEARCH ALL POSTS Not found any post match with your request Back Home Sunday Monday Tuesday Wednesday Thursday Friday Saturday Sun Mon Tue Wed Thu Fri Sat January February March April May June July August September October November December Jan Feb Mar Apr May Jun Jul Aug Sep Oct Nov Dec just now 1 minute ago $$1$$ minutes ago 1 hour ago $$1$$ hours ago Yesterday $$1$$ days ago $$1$$ weeks ago more than 5 weeks ago Followers Follow THIS CONTENT IS PREMIUM Please share to unlock Copy All Code Select All Code All codes were copied to your clipboard Can not copy the codes / texts, please press [CTRL]+[C] (or CMD+C with Mac) to copy